নিজস্ব প্রতিবেদক ::
কুড়িগ্রামে হাজার কোটি টাকার সামরাজ্য গড়েছেন, সাবেক প্রাথমিক ও গনশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। তিনি
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) । জাকির হোসেন গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন কুড়িগ্রামের রৌমারীর মানুষ। দলীয় ও সরকারি প্রভাব বিস্তার করে তিনি গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। হয়রানি আর নির্যাতনের ভয়ে প্রায় দেড় দশক ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করার সাহস পাননি বলে জানিয়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগের লোকজনও এখন তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
জাকির হোসেন কুড়িগ্রাম-৪ আসনের (রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারী) দুইবারের নির্বাচিত সাবেক এমপি। তিনি রৌমারী উপজেলার বাসিন্দা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
স্থানীয়রা জানান, রৌমারীর স্থলবন্দরগামী তুরা রোডের পাশে শেখ ফজিলাতুন নেছার নামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এজন্য সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের জায়গা দখল করা হয়। এটি করা হয়েছে জাকির হোসেনের নির্দেশে। তা ছাড়া এর পাশে কৃষকদের আবাদি জমি দখলে নিয়ে বালু ভরাট করে তৈরি করেছেন পাথর ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। মামলা করেও সেই জায়গা পুনরুদ্ধার করতে পারেননি ভুক্তভোগী কৃষকেরা।
ওই জমির পাশে একটি জমি কিনেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. জালাল। প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ করে মাটি ভরাট করে বাড়ি করেছিলেন ভাঙনে ভিটাহারা এই স্কুলশিক্ষক। তাঁকেও স্থানীয় এমপি ৫ লাখ টাকা ধরিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করেছেন।
বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক জালাল বলেন, ‘আমারে টাকা ধরাইয়া দিয়া কইল ঘর সরায় নিতে। সরায় নিলাম। তারপর আমার রেকর্ড করা জমিতে বালু ফেলে দখলে নিছে। জায়গাতেও লোকসান, টাকাতেও লোকসান। কী করমু, তাঁর ক্ষমতার কাছে আমরা টিকতে পারি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে যে জায়গা দখলে নিছে তার অর্ধেক খাস আর অর্ধেক ব্যক্তিমালিকানাধীন। কারও জমির টাকা দেয় নাই।’
সাবেক প্রতিমন্ত্রীর দখলের শিকার বামনের চর গ্রামের কৃষক দানেজ আলীও। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী হওয়ার পর আমাগোরে এহানে অন্তত ১৪-১৫ জন কৃষকের রেকর্ডি জমি সে দখলে নিছে। আমার ৪ কাঠা জমিত বালু ফেইলা বাঁধছে। ওগুলা আবাদ কইরা আমাগো সংসার চলত। জমিতে ধানের বিচন (বীজ) ফেলছিলাম। হের ওপরে সে বালু ফেলছে। জমির বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও আমরা কিছুই করতে পারি নাই। তার কাছে টিকতে পারি না। আমরা জমি ফেরত চাই।’
উপজেলার চরশৌলমারী ইউনিয়নেও পড়েছে জাকির হোসেনের দখলের ছাপ। ইউনিয়নের টোপপাড়া গ্রামে ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন স্থানে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের নামে প্রতারণা করে কয়েক একর জমি নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে করে নিয়েছেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে জায়গাগুলোর তিনদিক ঘিরে একটি ভবন তৈরি করা হচ্ছে। পূর্ব প্রান্তে দিয়েছেন অস্থায়ী বেড়া।
মো. দেলোয়ার নামের ওই এলাকার এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের এখানে আগে বিদ্যুৎ ছিল না। সে (জাকির) এলাকায় আইসা মানুষজনকে নিয়া মিটিং করে। সৌরবিদ্যুৎ চালু করার নামে মানুষের কাছ থেকে দলিল করে নিছে। তার ভেতরে যে চক্রান্ত ছিল তা মাইনষের জানা ছিল না। জসিম স্যারসহ অনেকের জমি দলিল করে নিছে। সৌরবিদ্যুৎ আর হয় নাই। এখন ওইহানে খালি গাঁজা-মদের আডডা বসে।’
দেলোয়ারের কথার সূত্র ধরে স্থানীয় এক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক জসিম উদ্দিনের কাছে গিয়ে সাবেক এমপির প্রতারণার প্রমাণ মেলে। অবসরপ্রাপ্ত এই প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘তখন জাকির এমপি বলছিল সৌরবিদ্যুৎ এনে দেবে। আমাদের অংশীদারত্ব থাকবে।
এলাকার স্বার্থে আমরা কয়েকজন মিলে জমি দলিল করে দিছি। আমার জমি বিক্রি করার প্রয়োজন ছিল না। সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানির কথা বলে আমার ১৫ শতক জমি লিখে নিছে। আমার পরিবারের ১ একরেরও বেশি জমি লিখে দিছি। পরে আর প্রকল্প হয় নাই।’
জাকির হোসেনের প্রতারণার শিকার আরেক ভুক্তভোগী চরশৌলমারীর কৃষক আমজাদ। তিনি বলেন, ‘দেড় বছর আগে আমার ৫ শতক জমি দখলে নিছে। বাধা দিলে পুলিশ নিয়া আসছে। আমি বলছি, আমার খেত আমি কেন দিমু। অনেক তর্কাতর্কি হইছে। পরে দুই দফায় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিছে। জমির দাম ১০ লাখ।’
রৌমারী শহরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের জায়গা দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ, সদর ইউনিয়নের রৌমারী-ঢাকা সড়কের পাশে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও খাসজমি দখলে নিয়ে সরকারি যৌথ মালিকানায় জাকির হোসেনের স্ত্রীর নামে ‘শিরি অটো রাইস মিলস্’ তৈরিরও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া দাঁতাভাঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও এর পাশের মাজারের জায়গা দখলেরও অভিযোগ রয়েছে জাকিরের বিরুদ্ধে।
এদিকে উপজেলার ১৯১টি পরিবারকে আশ্রয়ণের ঘর এবং ৭২ পরিবারকে সৌরবিদ্যুৎ সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৬০ লাখ ৭২ হাজার টাকা নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে জাকির এবং তাঁর স্ত্রীসহ তিনজনের নামে গত ১ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রাম আদালতে মামলা করেছেন মোকছেদ আলী নামের এক ব্যক্তি।
সাবেক এমপির নানা অনিয়মের কারণে দলের ভেতরেও তাঁকে নিয়ে রয়েছে সমালোচনা। উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা আবিদ শাহনেওয়াজ তুহিন বলেন, ‘আমরা দলগতভাবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের কর্মকাণ্ড নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ বিব্রতবোধ করি। জমি দখল থেকে শুরু করে অনেক কিছুই তিনি করেছেন। আমরা দলের হাইকমান্ডকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম; কিন্তু অজানা কারণে দল ব্যবস্থা নেয়নি।’
তবে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে জমি দখল নিয়ে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমি কারও কোনো জমি দখল করিনি। সব জমির বৈধ কাগজপত্র আছে। আমি কারও এক আনা ক্ষতি করি নাই। যে অভিযোগ করা হচ্ছে, সেগুলো অপপ্রচার।’