অমিতাভ কাঞ্চন ::
নীরা আর্য (৫ মার্চ, ১৯০২ – ২৬ জুলাই, ১৯৯৯) আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের সৈনিক ছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন বাঁচাতে তিনি নিজের স্বামীকে হত্যা করেন। নেতাজী তাঁকে নীরা নাগিনী বলে অভিহিত করলে তিনি নীরা নাগিনী নামে পরিচিতি লাভ করেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে একজন গুপ্তচর হিসাবে গণ্য করেছিল।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও দেশের জন্যে নিজের স্বামীকেও পর্যন্ত হত্যা করতে দ্বিধা বোধ করেননি তিনি..! নাম তাঁর নীরা আর্য। আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর প্রথম গুপ্তচর..💥🇮🇳
আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন হওয়ার পর.. ব্রিটিশ ভারতের সিআইডি ইন্সপেক্টর ‘শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাস’কে গুপ্তচরবৃত্তি করে ব্রিটিশদের Most wanted ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু’কে হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অনেক চেষ্টার পর একসময় সুযোগ পেয়েই গেলেন শ্রীকান্ত। গাড়িতে থাকা নেতাজিকে হত্যার জন্য গুলি চালালেন, কিন্তু সেই গুলি নেতাজির গাড়ীর চালককে বিদ্ধ করলো। সেখানে ওই মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ‘রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট’-এর এক সদস্যা নীরা আর্য। জয়রঞ্জনকে তিনি আর দ্বিতীয় সুযোগ দেননি.. চোখের পলকে নীরা আর্য শ্রীকান্ত জয়রঞ্জনের পেটে বেয়নেট চালিয়ে হত্যা করলেন। শুধু এটুকুই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল।
কিন্তু এখানে একটা অভাবনীয় চমক রয়েছে.. শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন ছিলেন নীরা আর্যের স্বামী। হ্যাঁ.. নেতাজি ও দেশের জন্যে নিজের স্বামীকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করেননি নীরা আর্য.. 🔴
এই ঘটনার পর নেতাজি নীরাকে ‘নাগিনী’ নামে অভিহিত করেছিলেন।
নীরা আর্য আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম গুপ্তচর ছিলেন.. নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নিজেই নীরাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই কাজে তাঁর সঙ্গী ছিলেন মনবতী আর্য, বর্মার বাসিন্দা সরস্বতী রাজামণি, দুর্গা মল্লা গোর্খা এবং যুবক ড্যানিয়েল কালে।
নীরা আর্যের আত্মজীবনীতে বর্ণিত গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কিত ঘটনার নিম্নরূপ –
❝ আমার সাথে আরও একটি মেয়ে ছিল, নাম সরস্বতী রাজামণি। সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছিল এবং তাঁর জন্ম বার্মায়। সে এবং আমি একসময় ইংরেজ অফিসারদের গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আমরা মেয়েরা ছেলেদের পোশাক পরি এবং ব্রিটিশ অফিসারদের বাড়ি ও সামরিক শিবিরে কাজ শুরু করি। আমরা আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য এভাবে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছি। আমাদের কাজটি ছিল কান খোলা রাখা,সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলি নিয়ে আলোচনা করা, তারপরে নেতাজীর কাছে তা পৌঁছে দেওয়া। কখনও কখনও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নথিও বহন করতে হত।
যখন মেয়েদের গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল,আমাদের স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে,ধরা পড়লে নিজেরাই নিজেদের গুলি করতে। একটি মেয়ে তা করতে মিস করে এবং তাকে ইংরেজরা জীবন্ত গ্রেপ্তার করেছিল। এতে আমাদের সংগঠনের সমূহ বিপদ ও ক্ষতি হবে বুঝে আমি এবং রাজামণি স্থির করেছিলাম যে, আমরা আমাদের সঙ্গীকে যে কোনভাবে মুক্ত করব। আমরা নপুংসক নর্তকীর পোশাক পরে যেখানে আমাদের সঙ্গী দুর্গাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেখানে পৌঁছেছিলাম.. আমরা অফিসারদের মাদক খাইয়ে এবং আমাদের সঙ্গীকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার পথে পাহারায় থাকা এক সেনা গুলি চালায় এবং তাতে রাজামণির ডান পা গুলি বিদ্ধ হয়। কিন্তু তা স্বত্বেও সে কোনক্রমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এদিকে ধড়পাকড়ের জন্য অনুসন্ধান শুরু হলে আমি এবং দুর্গা একটা লম্বা গাছের উপরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। অনুসন্ধান নীচে অব্যাহত ছিল, যার কারণে আমাদের তিন দিন ধরে গাছের উপরে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় থাকতে হয়েছিল। তিন দিন পরে আমরা সাহস করে সুকৌশলে সঙ্গীদের নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের ঘাঁটিতে ফিরে আসি।
রাজামণির সাহসিকতায় নেতাজী খুশী হয়ে তাকে INA-র রানি ঝাঁসি ব্রিগেডে লেফটেন্যান্ট এবং আমাকে অধিনায়ক করেছিলেন..।❞🩷🌻
আজাদ হিন্দ ফৌজের বেশিরভাগ বন্দী সৈন্যকে দিল্লির লাল কেল্লায় বিচারে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নীরাকে স্বামী হত্যার কারণে দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। জেলে বন্দীদশায় তাঁকে অকথ্য শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।
তাঁর সেই জীবনী পড়ে জানা যায়, গ্রেপ্তারের পরে তাঁকে প্রথম কলকাতার এক কারাগারে রাখা হয়েছিল। তারপর তাঁকে আন্দামান জেলে পাঠানো হয়।
আর সেখানেই ঘটে এক নিদারুণ নৃশংস অত্যাচারের দৃষ্টান্ত..🔴
তাঁদের যখন কারাগারের ভেতরে নিয়ে রাত দশটায় মহিলা কয়েদিদের সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, শোওয়ার জন্য কম্বল ইত্যাদির কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। প্রবল শীতের রাতে তাঁর মনে মনে একটা উদ্বেগ হচ্ছিল যে, সেখানে গভীর সমুদ্রের অজানা দ্বীপে কাটিয়ে কীভাবে আমরা স্বাধীনতা পাব। রাত বারোটার দিকে একজন প্রহরী দুটি কম্বল নিয়ে এসে একটিও কথা না বলেই গায়ের উপর ফেলে দেয়। কম্বল গায়ে পড়ে যাওয়ায় তাঁর ঘুম ভেঙে খারাপ লাগলেও কম্বল পাওয়ার পরে খানিকটা আরাম হয়। যদিও গলায়, হাতে এবং পায়ে লোহার শক্ত ও ভারি শেকল দিয়ে বেঁধে রাখায় তাঁর শুতে বা বসতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।
সকালে সূর্যোদয়ের পর তিনি দেখে খুশি হলেন, সেই বদ্ধ ঘরের এক পাশে একটি জানলা রয়েছে। তার পর জেলখানার এক কামার এল। হাতের বেড়িগুলি কাটতে গিয়ে তাঁর হাতের একটু কেটে যায়, তবে পা থেকে শিকল-বেড়িগুলি কাটানোর সময় সেই কামারের হাতুড়ির কয়েকটা বাড়ি পায়ের উপর পড়ে হাড়ে দু-থেকে তিনবার চোট লাগে। প্রবল ব্যথা পেয়ে নীরা বলে ওঠেন, “আপনি কি অন্ধ নাকি যে পায়ে হাতুড়ি মারছেন?”
সে বলল, “আমরা তোমাকেও মেরে ফেলতে পারি, তুমি কী করবে?”
“আমি এই কারাগারে বন্দি, আমি আর আপনার সঙ্গে কীই বা করতে পারি?” এই বলে তিনি তাদের গায়ের উপর থুথু ছিটিয়ে বললেন, “মহিলাদের সম্মান করতে শিখুন।”
সেলুলার জেলের ইংরেজ সুপারও তখন সেখানে ছিলেন, তিনি উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেন, “তোমাকে একেবারে ছেড়েই দেওয়া হবে, যদি তুমি আমাদের বলে দাও তোমাদের পাণ্ডা সুভাষ বসু কোথায় আছে।”
“তিনি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন,” নীরা জবাব দিয়েছিলেন, “এটা এখন সারা বিশ্ব জানে।”
“বসু বেঁচে আছে… তুমি মিথ্যা কথা বলছ যে সে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছে।” জেলার বলল।
“হ্যাঁ, নেতাজি বেঁচে আছেন।”
“তো সে এখন কোথায়…?”
নীরা আর্য তখন তাঁর বুকের উপরে হাত রেখে বললেন, “নেতাজি আমার হৃদয়ে বেঁচে আছেন।”
এই কথা শুনে জেলারের চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে আমরা নেতাজিকে তোমার হৃদয় থেকেই সরিয়ে দেব, ছিনিয়ে আনব।” তার পর তারা বন্দিনির শাড়ির আঁচলে হাত দিয়ে এক হ্যাঁচকা টান দিল, জামার বুকের দিকটা ছিঁড়ে দিয়ে কামারের দিকে ইশারা করল। সেই কামার জেলের ফুলবাড়িতে গাছের পাতা কাটার মতো বড় সাইজের সরঞ্জাম ব্যবহার করছিল। সেগুলো তার সঙ্গেই ছিল। ওরকম একটা সাঁড়াশির মতো যন্ত্রকে উঠিয়ে সে নীরার ডান পাশের স্তনটিকে উন্মুক্ত করে কাটার চেষ্টা করে। যন্ত্রটির ধার কম ও কিছু অংশ বোধ হয় ভাঙা থাকায় মাংসের স্তর খুব একটা কাটতে পারেনি। কিন্তু স্তনের উপর যে বিষম চাপ পড়েছিল তাতে তাঁর অসহনীয় কষ্ট ও যন্ত্রণা হয়েছিল।
তারপর জেলার তাঁর গলা চেপে ধরে বলেছিল, “যদি আবারও জেলের স্টাফদের মুখের ওপর কথা বলো, তাহলে তোমার দুই বুকের উপরিভাগ আলাদা করে দেব। বেঁচে গেলে আজ। তোমার ভাগ্য ভালো যে এটি আগুন দিয়ে উত্তপ্ত করে আনা হয়নি। যদি এটি আগুন দিয়ে উত্তপ্ত করে আনা হত, তবে তোমার দুটি স্তন সম্পূর্ণরূপে ছিঁড়ে আলাদা করে দিতাম।”🔥
স্বাধীনতার পরে, ফুল বিক্রি করে জীবনযাপন করেছিলেন। তবে কোনও সরকারী সহায়তা বা পেনশন গ্রহণ করেননি নীরা আর্য। নীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা নিয়ে আত্মজীবনীও লিখেছেন। শেষ জীবনে হায়দরাবাদের ফালকনুমায় একটি কুঁড়ে ঘরে বাস করতেন নীরা আর্য। সরকারি জমিতে থাকার কারণে তার কুঁড়েঘরটিও শেষ মুহুর্তে ভেঙে দেওয়া হয়।
দরিদ্র, অসহায়, নিঃস্ব অবস্থায় এবং বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারনে চারমিনারের নিকটে ওসমানিয়া হাসপাতালে, ১৯৯৮ সালের ২৬ শে জুলাই, তিনি প্রয়াত হন। স্থানীয় মানুষেরাই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে..❤🩹🌿
ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এত সাহসী এক বীরঙ্গনাকে আমরা হেলায় ভাসিয়ে দিলাম শেষ জীবনে একটু সম্মানও দিতে পাড়লাম না … হতভাগ্য এই বীরঙ্গনার আজ ৫ মার্চ জন্মদিবস, আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি..🌷
সংগৃহীত © এক যে ছিলো নেতা